প্যারিস হাউস রহস্য
লেখক : বিনায়ক লোহনী
প্রথম দৃশ্য
(চারজন বালক ক্যারাম খেলছে)
প্রথম বালক – এটাও হেরে গেলি তোরা এটাকে নিয়ে আজ সারা দিনে ছয় বার হয়ে গেলো।
দ্বিতীয় বালক – ধুর, এরকম পার্টনার নিয়ে কী খেলা যায়। আমার আর ভালো লাগছে না।
তৃতীয় বালক – ঠিক আছে থাক। কিন্তু তুই তো বলেছিলি আজকে তোর জ্যাঠা মশাই আসবেন। তিনি তো এলেন না। বাইরে কতো ঠাণ্ডা আছে। বেরোবার ইচ্ছে করছে না। এই সময়ে তোর জ্যাঠা মশাইর কাছ থেকে একটা গল্প শুনলে মন্দ হোতো না।
দ্বিতীয় বালক – জ্যাঠা মশাই যখন বলেছেন আসবেন তখন আসবেনই। হাতীবাগান থেকে বোসপুকুর আসতে সময় তো লাগবেই।
তৃতীয় বালক – আচ্ছা, তোর জ্যাঠা মশাই এতো সব গল্প এতো গুছিয়ে বলেন, তিনি এই সব পড়লেন শুনলেন কোথা থেকে।
দ্বিতীয় বালক – আরে তোরা ভুলে গেলি। তোদের আগেও বলেছি, জ্যাঠা মশাই দেশের অনেকগুলো জায়গাতে চাকরি করেছেন। আর দীর্ঘকাল একটা হস্টেলের ওয়ার্ডেন ছিলেন, বাচ্চাদের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে তার এমন অভ্যাস হয়ে গেছে। আচ্ছা তোমরা কি জানো জ্যাঠা মশাই কটা গল্প জানেন।
চতুর্থ বালক – হ্যাঁ , 1800।
দ্বিতীয় বালক – হ্যাঁ ঠিক, 1800।
তৃতীয় বালক – 1800 ?
দ্বিতীয় বালক- তাহলে আর কি। পঞ্চতন্ত্র, হিতোপ্রদেশ, মহাভারত, আরেবীয়ন নাইটস্, Aesop’s Fables, এসব ছাড়া কতোগুলো হিন্দি, মারাঠি, দক্ষিণ ভারতীয় গল্প জানেন। আর বাংলা গল্পের তো কথাই ছেড়ে দাও।
(বাইরে থেকে জ্যাঠা মশাই এর কন্ঠ)
জ্যাঠা – (এখন দেখা যাচ্ছে না) কি রে, ক্যামন আছিস তোরা।
দ্বিতীয় বালক – আরে জ্যাঠা মোশাই।
তৃতীয় বালক – এবার জমবে।
(জ্যাঠার প্রবেশ)
জ্যাঠা – আজকের দশটার সময় ভাত খেয়ে নিয়েছিলাম।তারপর গরম চা এর সাথে পন্ডিত রবিশঙ্কর এর একটা বহু পুরানো রেকর্ড লাগাই। সত্যি কথা বলতে যেদিন থেকে রবিশঙ্কর প্রয়াত হলেন সেদিন থেকে ওনার ভাব নিয়েই মোটামুটি থাকছি।
দ্বিতীয় বালক – আপনার কী তার সাথে কখনো দেখা হয়েছিলো ?
জ্যাঠা – হ্যাঁ, দুই একবার দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। আর ওর কথা ভেবেই একটা অসাধারণ ঘটনা আমার মনে পড়ে গেলো যেটা আজ কে তোদের শোনাবো।
প্রথম বালক – তাহলে কী আজকে ভূতের গল্প হবে না ?
জ্যাঠা – আবার ভূত, ও ছাড়া কী গল্প হয় না বুঝি। গত মাস যে জুম্মান শেখ আর আলগু চৌধুরী এর গল্প শুনিয়ে ছিলাম ওতে কি ভূত ছিলো। কিন্তু আজকে যে গল্পটা শোনাবো ওতে ভূত না থাকলেও, সেরকম একটা কিছু পাবি।
চতুর্থ বালক – তাহলে বিলম্ব কিসের ? শুরু হয়ে যাক।
জ্যাঠা – আরে দাঁড়া দাঁড়া, আগে একটা গরম চায়ে চুমুক দিতে হবে যে। বাবা ফটিক, একটা ভালো চা দিয়ে যাতো। এবার মন দিয়ে শোন। প্রথম থেকেই গল্প শুরু হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। তোরা তো জানিস, আমি ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত এর ভক্ত। প্রথমে হয় আলাপ আর আস্তে আস্তে রাগ বাঁধে। আজকে যেহেতু রবিশঙ্কর এর প্রসঙ্গ তুলে নিয়েছি, তাই কিছু কথা ওকে নিয়ে বলতেই হবে। আর ততক্ষণে চাও চলে আসবে। আচ্ছা বলো, রবিশঙ্করের দাদার নাম কি ছিলো ?
দ্বিতীয় বালক – উদয়শঙ্কর।
জ্যাঠা – Right। আর উদয়শঙ্করই নিজের বিখ্যাত ডান্স ট্রুপের সদস্য করলেন দশ বছরের রবি কে। হয়তো দাদার মতই নৃত্য শিল্পী হয়ে উঠতেন রবি, কিন্তু সেতারী গোকুল নাগের সংস্পর্শে আসা দিশা ঘুরিয়ে দিল রবির জীবনের। তার কাছেই সেতার শেখার প্রথম পাঠ নিলেন রবিশঙ্কর। আমি 1930 এর দশকের কথা বলছি। সেই সময় তাকে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেই সময়কার অন্যতম সংগীত প্রতিভা অমিয়কান্ত ভট্টাচার্য। আচ্ছা সেতার বাদনে রবিশঙ্করের পাশে আর একটা নাম রাখা যায়, জানিস তো কার ?
(ছেলেরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে)
জ্যাঠা- জানিস না তো। ওস্তাদ বিলায়েত খান সাহেব। এই বিলায়েত খান-এর বাবা ওস্তাদ ইনায়াত খান সাহেবের কাছে সেতার শিখতে চেয়েছিলেন রবিশঙ্কর। কিন্তু মানুষের ভাগ্যে যেটা লেখা থাকে সেটা বদলাবে কে। রবিশঙ্কর টাইফয়েড জ্বরে কয়েক মাস অসুস্থ থাকলেন আর এর মধ্যে খান সাহেব এ জগতটাকে ছেড়ে চলে গেলেন। ওস্তাদ সাহেবের কাছে সেতার শেখার ইচ্ছে রবির মনেই রয়ে গেল।
প্রথম বালক – জ্যাঠা মোশাই, জেনেরাল নলেজতো অনেক হয়ে গেল এবার তো গল্প শুরু কর।
জ্যাঠা – আরে, একটু ধৈর্য ধর। আমার এই কথার মধ্যে কখন গল্প শুরু হয়ে যাবে তা বুঝতেই পারবি না। তাই বলছি মন দিয়ে শোন। মাইহার এর ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহেব উদয়শঙ্কর এর একটা পাশ্চাত্য ট্যুরে সংগীতকার হিসেবে গিয়েছিলেন। সেখানে উদয় রবিকে ওস্তাদজির কাছে সংগীত শিক্ষা নিতে বলেন। ওস্তাদজি রবিকে শুধু বাদ্যের শিক্ষা না দিয়ে সংগীত সাগরে ডুবিয়ে দিলেন। তারপর আর কি ! বিদেশ থেকে ফেরার পরে রবি ৫ বছর মাইহারে থেকে গেলেন। আচ্ছা, কেউ কী বলতে পারবে এই মাইহার জায়গাটি ঠিক কোথায় ? জানিস না তো, এলাহাবাদ থেকে বোম্বাই যে রেল পথ গেছে ওতে এলাহাবাদ আর জবলপুরের ঠিক মাঝখানে আছে মাইহার। মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলায়। সেখানে দেবির একটা বিখ্যাত মন্দির ও আছে। তখন তো মাইহার একটা ছোট গ্রাম ছিল। এইবার আমি বলছি আমি রবিশংকর কে প্রথম কোথায় দেখেছিলাম। বিখ্যাত সেতার বাদক মুস্তাক আলি খান রবির সংগীত কে প্রথম বারানসিতে শুনলেন। তিনি এতটা আপ্লুত হন যে কলকাতায় নিজের শিষ্য রতন সরকারের বউবাজার স্ট্রিটের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। শহরের বাঘা বাঘা সাংগীতবিদদের সামনে এই প্রথম রবি বাজালেন। এটা ১৯৪৩ এর ঘটনা। সেই বছর বাংলায় গণনাট্য আন্দোলন শুরু হল যেটা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটা যুগান্তকারী সময়তো ছিলই, বরংচ সারা দেশে সাংস্কৃতিক জীবনের উপরেও একটা গভীর দাগ কেটে ছিল। এই রতনবাবু ছিলেন আমার দাদার বাল্য বন্ধু। তাহলে আর কী, আমিও দাদুর সাথে সেখানে পৌঁছে গেলাম। আমার বয়স সেই সময় প্রায় ৮-৯ বছর ছিল। আমার মনে সেই ছবি আজও স্পষ্ট আছে। হলুদ ধুতি পাঞ্জাবি পরে রবিশংকর চোখ বন্ধ করে সেতার বাজাচ্ছেন। দেখে পুরো পীতাম্বর কৃষ্ণ মনে হচ্ছিল। যেমন শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজিয়ে সকলকে মোহিত করতেন তেমনই একটা জাদু রবিশংকরও করেছেন। দাদুর জন্য কলকাতার উচ্চাঙ্গ সংগীত মহলের আমার একটা access ছিলো। Back door entry যাকে বলা হয়। ধর্মতলার বিখ্যাত সংগীত বাদ্য নির্মাতা কানহাইলাল আর নদেরচাঁদ মল্লিকের সাথে আমার পরিচয় ছিল। তারাই রবিশংকরের বিশ্ববিখ্যাত সেতার বানিয়েছিলেন। সেটা এক বিশেষ ধরনের সেতার ছিল। এটা ঠিক প্রথাগত সেতার নয় বরংচ সেতার সুরবাহারের একটা মিশ্রণ ছিল। যাকে বলা যেত খরাজ পঞ্চমযুক্ত সেতার। রবিশংকর সর্বপ্রথম এই ধরনের সেতার বানিয়েছিলেন লখনউ এর প্রসিদ্ধ সেতার বাদক আর সেতার নির্মাতা ইউসুফ আলি খানের কাছ থেকে। কানহাইলাল আর নদেরচাঁদের মতই ধর্মতলায় আর একটা বিখ্যাত দোকান ছিলো রায়চাঁদ বাবুর।
(জ্যাঠা চায়ে চুমুক দিচ্ছেন)
জ্যাঠা – যাই হোক আজকে আমি যে ঘটনাটা শোনাতে যাচ্ছি সেটা হল এই রায়চাঁদ বাবুর নাতি মোহিতকে নিয়ে। মোহিত আমার সাথে বাগবাজার বিদ্যাপীঠে পড়তো। তার সাথে স্কুলের দিনগুলি থেকেই আমি অনেক এডভেঞ্চার করেছিলাম। আমার একটা বিশেষ ইন্টারেস্ট ছিলো seance করার। Seance মানে কোনো অশরীরি আত্মাকে এক শরীরের মাধ্যমে প্রবেশ করানো এবং সেই মাধ্যমে তার সাথে বার্তালাপ করা। যে ঘটনাটা আমি তোমাদের শোনাতে যাচ্ছি এটা ১৯৬৩ সালের। তখন আমি পুনায় ডেকান কলেজে B.Sc Mathematics-এ পার্ট টাইম লেকচারার ছিলাম। দূর্গা পুজার সময় কলকাতায় এসে ছিলাম আর সেখানেই মোহিতের সাথে দেখা হয়। তখন সে আলমোড়া যাওয়ার প্রসংগ তুললো। এইবার আমি যা বলবো ওটাকে মনের পর্দায় নাটক বা সিনেমার মতো চালিয়ে যাবে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
মোহিত – তাহলে বল দশমির পরে পাঁচ দিন বার করতে পারবি কি না ?
ত্রিলোচন – আলমোড়া ? সেখানে কি কাজ পড়ে গেল।
মোহিত – কাজ তো আছেই, কিন্তু আলমোড়া গিয়ে কাছেই নৈনিতাল আর রানিখেতও হয়ে আসবো। আসলে আলমোড়া গিয়ে একটা লোকের সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। গোয়েন্দাগিরি বলতে পারিস।
ত্রিলোচন – ব্যাপারটা কি পরিষ্কার করে বল।
মোহিত – শুনে তোর আশ্চর্য লাগবে। আমার ঠাকুরদা রায়চাঁদ বাবুর সম্পর্কে তো তুই জানিস। বাদ্যযন্ত্র বানানোর ক্ষেত্রে সারা ভারতে তার সুনাম রয়েছে। বড় বড় ওস্তাদ লোক ঠাকুরদার কাছ থেকে নিজের যন্ত্রগুলি তৈরি করাতো। এসব সঙ্গীতবিদ ছাড়াও তার কিছু সৌখিন কাস্টমারও ছিল। এদের মধ্যেই একজন ছিলেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের ব্যারিস্টার আশুতোষ দত্ত চৌধুরী মহাশয়। এই দত্ত চৌধুরী মশাই ঠাকুরদাকে দু-তিনবার কিছু অর্ডার দিয়েছিলেন। ঠাকুরদার সাথে তার খুব বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল না। শুধু এই জানা ছিল যে তিনি এলাহাবাদের একজন সফল আইনজীবী ছিলেন। আর তিনি উচ্চ শ্রেণীর একজন সম্ভ্রান্ত মানুষ এইটা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না । ১৯১৩ সালে এই দত্ত চৌধুরী মহাশয় একটা বিশেষ ধরনের দামি সেতার তৈরি করার অর্ডার ঠাকুরদাকে দিলেন। প্রতিবারের মতো এবারও ঠিকানা দিয়েছিলেন 15, Bright End Corner, Almora । যদিও প্রত্যেকবার তিনি কলকাতায় এসে নিজেই অর্ডার রিসিভ করতেন কিন্তু এইবার তিনি এলেন না। প্রতিবারের মত এবারেও তিনি আগেই ফুল পেমেন্ট করে দিয়েছিলেন। সেকালের উচ্চশ্রেণীর ভদ্রলোক এডভান্স-ব্যালেন্স এর ব্যাপারে যেতেনই না। তারা পুরো পেমেন্ট একসাথে করে দিতেন। অনেক সময় কেটে গেল দত্ত চৌধুরী মশাই সেতার নিতে এলেন না। ঠাকুরদাও ভাবলেন যে কোনো ব্যক্তিগত বা পেশাগত সমস্যার জন্য দত্ত চৌধুরী মশাই কলকাতায় আসতে পারেননি। দীর্ঘ সময় কেটে যাওয়ার পরে কোনো সম্পর্ক সূত্রে ঠাকুরদা জানতে পারলেন যে দত্তচৌধুরী মশাই তার পরিবারের সাথে একটা পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তার বাকি পরিবার নিয়েও কোন খবর পাওয়া যায়নি এই কারনে সেই সেতারটি আমাদের এখানেই পড়ে রইলো। এইবার আমি যা বলব সেটা শুনে তুই হাসবি।
ত্রিলোচন – আরে বল না, আমি এতো সহজে কোনো ব্যাপারে হাসি না।
মোহিত – ঠাকুরদার বয়স প্রায় ৯০ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরেই থাকেন। কিছুদিন আগে তিনি আমাকে ডেকে বললেন যে একটা স্বপ্ন তাকে বেশ কিছুদিন ধরে ডিস্টার্ব করছে।
ত্রিলোচন – স্বপ্ন ?
মোহিত- হ্যাঁ স্বপ্ন। ঠাকুরদা মাঝে মাঝে স্বপ্নতে সে সেতারটি দেখেন। দত্ত চৌধুরী মশাই এর চেহারাটা তার অতটা মনে নেই। কিন্তু স্বপ্নে একটা মুখাকৃতি চলে আসছে। আর দত্ত চৌধুরী মশাই এর ফুল পেমেন্টের কাউন্টার-কপিও সামনে আসছে। যখন চার-পাঁচবার এই স্বপ্ন ঠাকুরদাকে ডিস্টার্ব করলো তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন যে সে সেতারের ফুল পেমেন্ট নেওয়ার পরেও সেটা আমাদের কাছে পড়ে রয়েছে, সেই কারনে এই স্বপ্ন বার বার আসছে। ঠাকুরদা আমাকে বললেন যে এলাহাবাদ বা দরকার পড়লে আলমোড়া গিয়ে দত্ত চৌধুরী মশাই এর উত্তরসূরীদের খোঁজনি আর যদি কাউকে পাওয়া যায় তাহলে ওকে এ সেতারটা দিয়ে ব্যাপারটা শেষ করা হোক। আমি ঠাকুরদাকে বললাম যে এই সময়ে দুটো জায়গায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। হ্যাঁ দশমির পরে আলমোড়া যেতে পারি। অভিযান যদি বিফলও হয় তাহলেও পাহাড় ঘোরা তো হয়ে যাবে। এমনিতেই আলমোড়া নৈনিতাল ঘোরার ইচ্ছা আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল। বিশেষ করে Corbett এর ‘Man-Eaters of Kumaon’ পড়ার পর। এইবার বলো যাবে কি যাবে না।
ত্রিলোচন – Kumaon ঘোরার সুযোগটা ছাড়া উচিত না। কিন্তু একাদশির সময় রেল টিকিট কি পাওয়া যাবে ?
মোহিত – আরে সে চিন্তা ছাড়। আমার দাদার শশুর মশাই ইস্টার্ন রেলওয়েতে zonal manager আছেন। তাদের ইমারজেন্সি কোটা বলে কিছু একটা হয়। আমি একা তো এমনি যেতাম না তাই তাকে বোলে রেখেছিলাম যে দশমির এক-দুদিন পরে দুটো Berth লাগবে। তিনি আমাকে বললেন যে এক-দুদিন আগে জানালে হয়ে যাবে। এইবার তো শুধু গরম জামা কাপড় নিয়ে রেডি হয়ে যা।
ত্রিলোচন – আমি আজকেই নিউ মার্কেট গিয়ে কিছু গরম কাপড় নিয়ে বাড়ি ফিরবো।
মোহিত – এই হলো না কথা। তাহলে আলমোড়া আসছি আমরা।
ত্রিলোচন – আলবাত।
তৃতীয় দৃশ্য
জ্যাঠা – এইভাবে আমরা আলমোড়া পৌঁছে গেলাম।অক্টোবর মাসে আলমোড়ায় ঠান্ডাটা কিন্তু কম ছিলনা। সমুদ্রতট থেকে 5500 ফুট উচ্চতাতে আছে এই আলমোড়া নগর। আমরা গিয়ে একটা lodge এ ঘর ভাড়া করলাম। বেশি চয়েস ছিল না যেহেতু ভালো হোটেলগুলো এমনিতেই ফুল বুকড্ চলছিলো। আমি থাকা খাওয়া পরাকে এমনিতে কখনও বেশি গুরুত্ব দিনি, তাই মজায় ছিলাম। আগে একটু কাজটা করেনি এই ভেবে স্নান সেরে 15, Bright End Corner এর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। পৌঁছে দেখলাম যে একটা সাত লিভারের আলিগড়ি তালা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। বাড়ির সাথে একটা বাগান ছিল। গেট থেকে প্রায় ১৫ মিটার ভেতরে বাড়ি ছিল। বাড়ির সারা রং উড়ে গেছিল আর বাগানে অবস্থা নিয়ে যতটা কম বলি ততটা ভালো। ঝাড়িগুলো ৮-১০ ফুট পর্যন্ত উঠেছিল সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে সাঁপ, পোকাদের জন্য একটা আদর্শ পরিবেশ। দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে একটা যুগ ধরে কেউ এখানে থাকছে না। মেন্টেনেন্স এর কোন চিহ্ন নেই। স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞাসা করার পর জানা গেল যে এই বাড়িকে ফরাসি বাংলো বলা হয়। এর চেয়ে বেশি কেউ কিছু বলতে পারলো না। এরপরে একটা-দুটো Sights দেখার পরে আমরা lodge এ ফিরে এলাম। দুপুরে খাওয়ার পরে ম্যানেজারের সাথে ফরাসি বাংলোর কথা তুলে এটা জানতে পারলাম যে lodge এরই লাগোয়া পুরানো গলিতে একজন হালদার মহাশয় থাকেন। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে আলমোড়া বেঙ্গলি এসোসিয়েসন এর সভাপতি আছেন আর দূর্গা পূজারও প্রধান দায়িত্ব তিনি বহন করেন। তার বয়স প্রায় ৬০ আর তিনি ছোটবেলা থেকেই আলমোড়ায় থাকছেন। শুনেই মনে হলো এনার সাথে তো দেখা না করলেই নয়। তিনি অবশ্যই 15, Bright End Corner ফরাসি বাংলোর সম্পর্কে কিছু না কিছু জানাতে পারেন। দুপুরে হয়তো তিনি বিশ্রাম করেন, এই ভেবে আমরা ঠিক করলাম যে ৫ টার সময় তার সাথে দেখা করতে যাবো।
চতুর্থ দৃশ্য
হালদার মহাশয় – ফরাসি বাংলো, প্যারিস হাউস ! অনেক দিন ধরে কিছু শুনিনি সেখানকার সম্পর্কে। এক সময় কতগুলো গল্প গুজব শুনতাম ফরাসি সাহেবের আত্মহত্যার পরে।
ত্রিলোচন – আত্মহত্যা !
হালদার মহাশয় – হ্যাঁ, ফরাসি সাহেব বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। বাড়ির চাকর পরের দিন বৈঠকখানায় একটা easy-chair এর উপরে তার দেহটাকে দেখে। পুরানো গোরস্থানে তাকে কবর দেওয়া হয়। যেহেতু তার কোনো আত্মীয়দের সন্ধান ছিলো না, তাই চার্চের ফাদার তার শেষকৃত্য করলো। সাহেবের বয়স কত হবে, এই সাতাশ-আঠাশ। তখন তো আমার বয়স ছিল তেরো-চোদ্দো। আমরা বন্ধুরা প্রায় সময়ই তাকে পাহাড়ি রাস্তাগুলোতে horse-riding করতে দেখতাম। বেশি ইংরাজি তো তখন আমরা জানতাম না। তাই ওকে আমরা ‘good morning, good evening’ এই সব বলতাম। তিনিও অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে আমাদের greet করতেন। কি সুন্দর চেহারা ছিল সাহেবের, ৬ ফুট ৩ ইঞ্চ হাইট, লম্বা চুল, ফর্সা মুখ। এক অত্যন্ত আকর্ষণীয় appearance ছিল সাহেবের।
মোহিত – সেসব তো ঠিক আছে, কিন্তু আপনি কি আশুতোষ দত্ত চৌধুরী সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন।
হালদার মহাশয় – না, তা তো জানি না। বাবার কাছ থেকে শুনেছিলাম যে একজন বাঙালি ভদ্রলোক ফরাসি বাংলোতে কিছু সময় থেকেছেন, সম্ভবত তিনি এই বাড়ি ফরাসি সাহেবকে বিক্রি করলেন।
মোহিত – তাহলে এই দত্ত চৌধুরি মশাই এর সম্পর্কে বা তার উত্তরসূরীদের সম্পর্কে কেউ জানাতে পারে এমনকি কেউই নেই আলমোড়ায় ?
হালদার মহাশয় – মনে তো হয় না। তিনি এখানে বাড়ি তৈরি করলেন কিন্তু কদিনই বা থাকলেন। আর তার কোন সোশ্যাল সার্কেল ছিল বলে আমার তো মনে হয় না।
ত্রিলোচন – আচ্ছা আপনি যে বললেন সে বাড়ি সম্পর্কে অনেক গল্প গুজব ছড়ানো ছিল সেটা নিয়ে একটু বলবেন।
হালদার মহাশয় – সে বাংলো নিয়ে একটা ধারণা ছিলো যে সেটা একটা ভূতুড়ে বাড়ি। ভূতের প্রকোপ ছিল সেখানে, এইসব কথা আর কি। বর্তমানে কেউ ওখানে যায় বলে আমার মনে হয় না। অনেক বছর আগে এটা শোনা যেত, যে কেউ ফরাসি সাহেবকে পায়চারী করতে দেখেছে। তেমনি এরকমও শোনা যেত সকাল সকাল তাকে horse-riding করতে দেখেছে। এবার কোন কথা সত্য কোন মিথ্যে, কতটা সত্য কতটা মিথ্যে এ ভগবানই জানে।
ত্রিলোচন – সে বাড়ির নাম আগে থেকেই প্যারিস হাউস ছিল আর স্থানীয় মানুষ তাকে ফরাসি বাংলো বলতো, তাই তো ?
হালদার মহাশয় – হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়। আমাদের বাল্যকালেও আমরা ওটাকে প্যারিস হাউসই বলতাম, কিন্তু বেশির ভাগ স্থানীয় মানুষ তাকে ফরাসি বাংলো বলতো।
ত্রিলোচন – বর্তমানে কি কেউ যায় ওখানে ?
হালদার মহাশয় – দিনের সময় হতে পারে কিছু ছেলে ছোকরারা ঘোরে। সেখানকার দামি দামি লাইটিং আর ফার্নিচার আগে থেকেই উধাও আছে। সেকালের ইংরেজ কালেক্টর সাহেব বাড়িটাকে সীল করে দিয়েছিলেন আর একজন দারোয়ানও রেখেছিলেন। হয়তো এখনো নামের জন্য কেউ হতে পারে আর কেউ মজায় বেতন উপভোগ করছে । কিন্তু রাত্রে কেউ ওখানে যায় বলে আমার তো একদমই মনে হয় না। চার-পাঁচ বছর আগে আবার শোনা গিয়েছিল যে কেউ সাহেবকে ঘোড়ার উপরে উঠতে দেখেছে। সব মিলিয়ে সেই বাড়িটির reputation পুরোপুরি ভূতুড়ে বাড়ির মতনই রয়েছে।
ত্রিলোচন – (মোহিতের দিকে তাকানোর পরে) আপনার অনেক সময় নিলাম। অনেক কিছু ইন্টেরেস্টিং তথ্যগুলো জানতে পারলাম আপনার কাছ থেকে।
হালদার মহাশয় – খুব বেশি নতুন মানুষদের সাথে এখানে আলাপ হয় না তাই আপনাদের আসায় ভালোই লাগলো। এখন কিছুদিন থাকবেন তো আলমোড়ায়, সময় পেলে আবার আসবেন। একটু আড্ডা জমবে। বাঙালি হয় আর আড্ডা না হয় এটা কি হতে পারে।
মোহিত – অবশ্যই আসব, তাহলে আজকে উঠি।
পঞ্চম দৃশ্য
মোহিত – কাল সকালের এখানকার কিছু আর sights দেখে ঘুরে নৈনিতাল বেরিয়ে পড়ি। দু-এক দিন নৈনিতালে থাকব। ছুটিটা একটু বাড়িয়েনে, রানিখেতও যাব। গরমের সময় এলে আমরা পিন্ডারি Glacier tracking এ যেতে পারতাম।
ত্রিলোচন – আমার মন তো সেই প্যারিস হাউসের দিকে পড়ে আছে।
মোহিত – আরে ছাড় তো সেই প্যারিস হাউস। ঠাকুরদা জানিনা কি সব স্বপ্ন দেখলেন, আমাদের এই ভূতুড়ে বাড়ির পিছনে লাগিয়ে দিলেন। এপ্রিলের মাস হলে মনে হতো যে এপ্রিল ফুল বানাচ্ছেন।
ত্রিলোচন – তোর না সত্যি, Beaten track-এ হাটার অভ্যাস আছে। একটু কিছু unpredictable হলে তোর জানি না কি হয়ে যায়। আরে ছোট বয়েসে আমরা কত সব এডভেঞ্চার করতাম। যখন এখানে পৌঁছেছিলাম তখন কি ভাবতে পেরেছি একটা ভূতুড়ে বাড়ি পাব। যেখানে একটা মৃত ফরাসি সাহেবের অশরীরী আত্মা Horse-Riding করে বেড়ায়। এসব যে মালমশলা আছে এতে তো জবর একটা রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস হয়ে যেতে পারে। আর এইসব শুনে আমার ইমাজিনেশন একটা জোরদার কিক পাচ্ছে।
মোহিত – (হেসে) তুই না একটা কাজ কর। দশ-পনেরো বছর ভালো করে কিছু টাকা জমা কর, তারপর প্যারিস হাউসটা কিনেনে। তারপর তুই ইউরোপীয় পোশাকে আর লম্বা চুলের একটা Wig পরে অন্ধকারে ঘোড়ায় বেরিয়ে যা। সবাই বলবে ফরাসি সাহেব আবার চলে এসেছে।
ত্রিলোচন – দশ-পনেরো বছর পরে কি করবো তা তো জানি না। হ্যাঁ, আজ রাত্রে কি করবো এই আইডিয়া আসছে মাথায়।
মোহিত – (একটু স্তব্ধ হয়ে) এইবার কি বলছিস।
(ত্রিলোচন হাসে)
মোহিত – দেখ ভাই তোর কোনো উদ্ভট প্লানিং-এর মধ্যে আমি কিন্তু নেই। এমনিতেই আজ সারাদিন পাহাড়ি রাস্তায় হেটে গায়ে এক-একটা হাড় যন্ত্রণা করছে। আমি তো সোজা ঘুমাতে যাবো।
(ত্রিলোচন আবার হাসে)
মোহিত – তোর এই হাসিটা বন্ধ কর আর বল তোর মাথায় কি ভূত চেপেছে।
ত্রিলোচন – ভূত চেপেছে, না ওখানে গিয়ে চাপবে, সেটাতো ওখানে গিয়েই জানা যাবে। একটা কাজ করি মোহিত, আগেতো আমরা অনেক seance করতাম, চল না আজকে আমরা ওখানে গিয়েই সেরকম কিছু করি।
মোহিত- আমি ওখানে যাব না। তুই ওখানে যেতে চাইলে যা।
ত্রিলোচন – আরে ভাই, একটা ভূতুড়ে বাংলোর এতো কাছে এসে এই সুযোগটা কি ছেড়ে দেব। আর তুই তো জানিস আমার মন সবসময় এডভেঞ্চারের পিছনেই ছোটে। তোর যখন ইচ্ছা নেই তাহলে আর কি বলবো। আমি লাইট ডিনার করে প্রায় এগারোটার সময় ওখানে যাব। তিনটের আগে ফিরে আসব। সারা রাত ঠান্ডায় জেগে থাকার আমার ইচ্ছা নেই। এখন আমাকে একটু বাজার যেতে হবে। রাত্রের জন্য কিছু ছোটো-খাটো preparation নিতে হবে। আর তুই lodge-এর দারোয়ানকে বলে দিবি যে রাত্রে ভেতর থেকে তালা না লাগিয়ে দেয়।
মোহিত – তাহলে তুই যাবিই।
ত্রিলোচন – একদম।
ষষ্ঠম দৃশ্য
(পার্শ্বসঙ্গীতের সাথে ত্রিলোচনের অন্ধকারে প্রবেশ। সঙ্গীত শেষ হওয়ার পর সে একটা মাদুর পাতে। সারা ঘরের দিকে টর্চের আলোয় ঘরকে ভালো করে দেখে নেয়। নিজের ব্যাগ থেকে একটি ছোট ব্যাটারি ল্যাম্প বার করে, নিজের হাতে মুখে তেল মাখায় আর কাছাকাছি একটা স্প্রে মারে। কিছুক্ষন ওখানে বসে থাকে। হঠাৎ মোহিতের গলা বাইরে থেকে আসে। ‘ত্রিলোচন, ত্রিলোচন ‘ মোহিত এই বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়)
ত্রিলোচন – তুই এখানে ?
মোহিত – তোকে কি একা ছাড়তে পারতাম।
(দুজন একে অপরের কাধে হাত রাখে)
ত্রিলোচন – আয় বস, স্যান্ডউইচ এনেছি, ফ্লাস্কে কফিও আছে একটু খেয়ে নে।
মোহিত – তুই তো seance করার কথা বলেছিলি।
ত্রিলোচন – সত্যি কি করতে চাস ?
মোহিত – Lodge-এ একা ভালো লাগছিল না। এখন যখন এখানে এসেই পড়েছি তখন দেখাই যাক না কি হয়।
ত্রিলোচন – তাহলে হয়ে যাক।
(ত্রিলোচন ব্যাগ থেকে একটা মোমবাতি বার করে, আর মাদুরের পাশে রেখে দেয়। দুজনে ধ্যানে বসে যায়। 30 সেকেন্ড পর্যন্ত পার্শ্বসঙ্গীত)
ত্রিলোচন – Is anyone here ? Is anyone here ?
মোহিত – Yes, I’m here.
ত্রিলোচন (মোহিতের দিকে তাকায়) Who are you ?
মোহিত – Whose house you have come to.
(এইবার বাংলায় বলছে) যার বাড়িতে তুমি এসেছো। আপনিতো বাঙালি, আমিও একটু বাংলা জানি। আমার সাথে বাংলায় কথা বললে আমার ভালো লাগবে।
ত্রিলোচন – আপনি কি করে জানেন আমি বাঙালি।
মোহিত – আমি তো কোনো শরীরের মধ্যে বদ্ধ নই। শরীরের সকল বাধন থেকে মুক্ত। আমার জন্য সেসব জেনে নেওয়া, করে নেওয়া সম্ভব যেটা শরীরে থাকতে সম্ভব নয়।
ত্রিলোচন – আমি কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
মোহিত – নির্দ্বিধায়।
ত্রিলোচন – আপনি তো একজন ফ্রেঞ্চম্যান।
মোহিত – হ্যাঁ বলতে পারেন।
ত্রিলোচন – আমি শুনেছি আপনার লম্বা চুল ছিল, আপনি ঘোড়া নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় Horse-Riding করতেন।
মোহিত – আরে সেটাতো এক যুগ আগেকার কথা।
ত্রিলোচন – এটা কি সত্যি যে আপনি আত্মহত্যা করেছিলেন।
(মোহিতের মুখের ওপর গম্ভীর ভাব চলে আসে কিছুক্ষণ কোনো জবাব নেই)
মোহিত – হ্যাঁ, আমি নিজেই আমার প্রাণ নিয়েছিলাম। আপনি সেই যে জায়গা দেখছেন সেখানে একটা easy-chair রাখা থাকতো। ওখানেই সেদিন wine এ আর্সেনিক মিলিয়ে খেয়ে নিয়েছিলাম।
ত্রিলোচন – সেই সময় আপনার বয়স কত ছিল ?
মোহিত – তেইশ। আমার বয়স মনে রাখা খুবই সহজ। 1900 সালে আমার জন্ম আর 1923 এ এই জগৎ ছাড়লাম। গান্ধীজী যখন তার আন্দোলন প্রত্যাহার করেছিলেন তার কিছু মাস পরেই।
ত্রিলোচন – এই বাড়িটা আপনি কবে কিনলেন ? এই বাড়িটির পুরানো মালিক আশুতোষ দত্ত চৌধুরীর কোনো স্মৃতি আছে কি আপনার মনে ?
(কিছুক্ষন নীরবতা)
মোহিত – কে বললো যে আমি এ বাড়ি কিনেছিলাম। আশুতোষ দত্ত চৌধুরী আমার বাবা।
ত্রিলোচন – আপনার বাবা ?
মোহিত – হ্যাঁ আমার বাবা। আর এই জন্যই আমি এই বাড়িতে থাকতাম। আমার ছোট বয়েসের অনেক স্মৃতি আছে এই বাড়িটাকে নিয়ে। তখন আমি ফ্রান্স -এ একটা বোর্ডিং স্কুলে পড়তাম। ছুটির সময়ে এখানে আসতাম। এক মাস বাবার সাথে থাকতাম। শুধু আলমোড়া নয় আমরা অনেক সময় নৈনিতালও ঘুরতে যেতাম। সেখানে লেকে বোর্টিং করতাম, মাল রোডে হাটতাম। এখানে আমাদের বাগানে বসে কয়েক ঘন্টা হাল্কা রোদ্দুরের আনন্দ উপভোগ করতাম। আমি যত বাংলা শিখেছি সব বাবার কাছ থেকেই।
ত্রিলোচন – কিন্তু আমরা তো এই জানতাম যে আপনার বাবা তার স্ত্রী ও বাচ্ছাদের সাথে একটা পথ দুর্ঘটনায়………..
মোহিত – মৃত্যু হয়ে গেছিল তাই তো। এটা একদম ঠিক কথা। আমার বাবা ১৮৯৬ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে ছিলেন তখন তার আমার মায়ের সাথে আলাপ হয় আর বিবাহ হয়। এই কথা ফ্রান্সের কিছু বিশেষ বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানতো না। মায়ের মা বাবা খুব কম বয়সে মারা গিয়েছিলেন। গরিব মামাই মাকে মানুষ করেছিলেন। মা খুবই গুণী মহিলা ছিলেন। অসাধারণ ভায়লিন বাজাতেন। বাবাও সংগীতপ্রেমি ছিলেন। সংগীত প্রেমই দুজনের মিল করিয়েছিল। আমি ছোট বয়স থেকে Mozart, Beethoven শুনে বড়ো হয়েছি। বাবা আমার শিক্ষার জন্য টাকা পাঠাতেন আর ওতেই আমি বোর্ডিং স্কুলে পড়তাম। বাবাও প্রতি বছর এক-দু মাস ফ্রান্সে থাকতেন। ১৯১৩ সালে বাবা আর আমার এখানকার ফ্যামিলি – ভাই বিশ্বতোষ আর মহিতোষ এবং তাদের মা, যারা আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতোই না, সকলেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। বাবার বাকি সম্পত্তি হয়তো তার দূরের আত্মীয়রা পেয়ে গেছে। কিন্তু এই বাড়ি বাবা বিশেষ করে আমার আর আমার মায়ের নামে করেছিলেন। বাবার প্রয়াত হওয়ার পর মাও একবার এখানে এসেছিলেন, তখন আমার বয়স ১৫ ছিল। তার তিন-চার বছর পরে মাও প্রয়াত হন। তারপরে আমি পুরোপুরি একা হয়ে গেলাম। খুব কষ্ট করে আমি University পুরো করলাম।
ত্রিলোচন – এত সব কথা আপনি আমাকে জানালেন। আর একটা প্রশ্ন কি করতে পারি ?
মোহিত – বলো।
ত্রিলোচন – আপনি আত্মহত্যা কেন করলেন ?
মোহিত – মায়ের মৃত্যুর পরে যখন আমি পুরোপুরি একা হয়ে গেলাম। তখন ক্রিস্টিনা আমার এক মাত্র সাপোর্ট ছিলো। সে আমার সাথে University তে পড়তো। আমি ঠিক করলাম যে আমি মাঝে মাঝে এইখানে আলমোড়ায় থাকব। সংগীত আর সাহিত্যের চর্চা করবো। বাংলা সাহিত্য আরও ভালো করে পড়বো। ক্রিস্টিনা এটা একদমই পছন্দ করলো না। আমি যখন এখানে থাকতে শুরু করলাম তখন আস্তে আস্তে আমাদের দূরত্ব বাড়তে থাকলো। তারপর একদিন একটা চিঠিতে জানতে পারলাম যে সে এক ফ্রেঞ্চম্যানকে বিবাহ করছে। সেইদিন আমি দেড় রাত পর্যন্ত Beethoven শুনলাম। শোকসঙ্গীত হঠাৎ আমার মনকে ঘিরে নিল। আমার ভেতরে একরকমের নিয়তিবোধ, sense of destiny জেগে উঠলো। আমি হঠাৎ এই অনুভব করলাম যে আমার এখানকার সারা পরিবার এমনকি আমার জন্মদায়িনী মা সবারই অসাময়িক মৃত্যু হয়েছে। আমার পরিবারের এটাই নিয়তি। এটাকে Beethoven এর সঙ্গীতের প্রভাব বলুন বা আর কিছু। আমি জীবনের ব্যর্থতা আর সারহীনতা তীব্র ভাবে অনুভব করলাম। ব্যস সেই সময় (হালকা হেসে) wine এ আর্সেনিক। এখন অবশ্যই বুঝতে পারি যে শরীর ঈশ্বরের উপহার। শরীর চলে যাওয়ার পরেও আমরা মুক্তি পাই না শুধু অন্য গতি পায়। (কিছুক্ষণ নীরবতা) উপহারের কথা যখন এসেছে তখন অন্য একটা কথা মনে পড়ে গেলো। আমার তেরোতম জন্মদিনের উপলক্ষে Teen age-এ আমার প্রবেশে বাবা সেলিব্রেট করতে চেয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের সাথে আমার পরিচয় করাতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তিনি কলকাতা থেকে একটা ভালো সেতার তৈরি করালেন। এটা উনি আমাকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন কিন্তু আমার জন্মদিনের আগেই সে পথ দুর্ঘটনা হয়ে গেলো। আমার এখানে আসাও হলো না আর উপহারটা নেওয়াও হয়নি।
ত্রিলোচন – (রোমাঞ্চিত হয়ে) তার মানে সে সেতারটি আপনার জন্য নেওয়া হয়েছিল ? আরে ওটাতো আমাদের কাছে কলকাতায় পড়ে আছে।
মোহিত – কি বলছেন ? আপনি কি সে সেতারটিকে এখানে রেখে দিতে পারেন, সেই জায়গাটাতে।
ত্রিলোচন – অবশ্যই। আমি নিজে আলমোড়া এসে সেতারটিকে এখানে প্যারিস হাউসে রেখে যাব।
মোহিত – হা-হা-হা, প্যারিস হাউস ! বাবা এই নামটাও double meaning এ দিয়েছেন।
ত্রিলোচন – Double meaning ?
মোহিত – তাহলে আর কি। বাবা প্যারিস হাউস নাম প্যারিস শহরের নামে দেননি। ওটা ছিল Pari’s House মানে প্যারির বাড়ি।
ত্রিলোচন – এই প্যারি আবার কে ?
মোহিত – (হেসে) আমি। বাবা আমাকে ভারতীয় নাম দিয়েছিলেন। বাবার নাম আশুতোষ, আমার দুই ভাইয়ের নাম বিশ্বতোষ আর মহিতোষ, আর সেই ছন্দে বাবা আমাকে নাম দিয়েছেন পরিতোষ। আর বাবা আমাকে প্যারি বলে ডাকতেন। বাংলায় যাকে ডাক নাম বলা হয়।
(এক ভয়ংকর পার্শ্বসংগীত বেজে ওঠে। মঞ্চে পুরো অন্ধকার)
ত্রিলোচন – মোহিত, মোহিত, মোহিত। পরিতোষ বাবু।
সপ্তম দৃশ্য
(ত্রিলোচন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে lodge এর ঘরে ঢোকে। সেখানে বিছানায় কেউ কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে।)
ত্রিলোচন – তুই এখানে ?
মোহিত – (ঘুম থেকে উঠে) কেন কি হলো, তুই কবে ফিরলি, ওখানে কি হলো ?
ত্রিলোচন – তার মানে তুই ওখানে যাসনি।
(একটা ভয়ংকর পার্শ্বসংগীতের সাথে মঞ্চে পুরো অন্ধকার)
অষ্টম দৃশ্য
(জ্যাঠা মশাই হাসছেন, বাচ্চারা সব রোমাঞ্চিত)
দ্বিতীয় বালক – তার মানে তুমি প্যারিস হাউসে অতক্ষণ একটা ভূতের সাথে কথা বলছিলে, যেটা মোহিতের রূপ নিয়ে ওখানে বসে ছিলো।
জ্যাঠা মোশাই – তাই তো মনে হয়। মোহিতকে lodge-এ ঘুমিয়ে দেখে আমার যে অবস্থা হলো তা আমিই জানি।
প্রথম বালক – তারপর কি করলেন ?
জ্যাঠা মোশাই – তারপরে ? পরের দিন বরিয়া বিস্তার বেঁধে নৈনিতাল চলে গেলাম।
তৃতীয় বালক – সে সেতারের কি হলো ?
জ্যাঠা মোশাই – মোহিত প্রথমে আমার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করছিল না। তারপর কিছুদিন আমার চিত্ত অশান্ত দেখে আস্তে আস্তে আমার কথা বিশ্বাস করলো। ফিরে সে ঠাকুরদাকে এই ঘটনাক্রম তো জানাইনি কিন্তু ওনাকে এই সাজেস্ট করলো যে সেতারটিকে প্যারিস হাউসে রেখে দেওয়া উচিৎ হবে। ঠাকুরদাও এ কথা মেনে নিলেন আর ডিসেম্বরের ছুটিতে আমি আর মোহিত আলমোড়া গিয়ে দুপুরের সময় সে সেতার প্যারিস হাউসে রেখে এলাম। সত্যি কথা বলতে দিনের সময় ছাড়া প্যারিস হাউসে যাওয়ার সাহস আমারও ছিলো না।
(জ্যাঠা ঝুড়িভাজা মুখে দিয়ে আবার বললেন)
তারপরে বেশ কয়েকবার আলমোড়া গেলাম কিন্তু প্যারিস হাউস যায়নি। সরকার সেই পাড়ায় আবার একটা দারোয়ান রেখে দিয়েছিল। স্থানীয় মানুষদের কাছে জানতে পারলাম যে কোনো কোনো সময় ওখান থেকে সেতারের ধ্বনি শোনা যায়।
(সব বাচ্ছা রোমাঞ্চিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়)
জ্যাঠা মোশাই – এই ঘটনার এত বছর পরেও মোহিত কোনো কোনো সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, প্যারিস হাউসের ঘটনাটা সত্যি হয়েছিল না একটা গল্প গড়েছিলি।
(সব বাচ্চারা হাসে)
তাহলে ‘story of the month’ হয়ে গেল। এইবার বাবা ফটিক, তোমার কি করনীয় ?
সব বাচ্চারা একসাথে – জ্যাঠা মোশায়ের জন্য একটা গরম গরম চা।